সত্য বার্তা ডেস্ক :
ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিরতার নেপথ্যে খুচরা বা পাইকারি ব্যবসায়ীরা নন, খলনায়কের ভূমিকা আছেন মিলাররা। সরবরাহ বন্ধ রেখে মূল কারসাজিটা করছেন তারাই। আর দাম বাড়াতে ঘি ঢালছেন কিছু অসাধু ডিলার। গত এক মাস মিলাররা কোনো সয়াবিন তেল বিক্রি করেননি বলেও অভিযোগ করেছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ভোজ্যতেল আমদানির ৯০ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করে বড় পাঁচ প্রতিষ্ঠান। তাদের ইচ্ছাতেই ভোজ্যতেলের দাম বাড়ে বা কমে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের হাতে শুধু বাজারই নয়, সরকারও এক অর্থে জিম্মি। ফলে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ নাগরিকদের। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকারকে সুস্পষ্ট অবস্থানে যেতে হবে বলে মনে করেন তারা।
এদিকে গতকাল মঙ্গলবার ভোজ্যতেলের খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের নিয়ে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ভোজ্যতেলের দাম নিয়ে কারসাজি বন্ধে পাকা রসিদ ছাড়া পাইকারি পর্যায়ে আর ভোজ্যতেল বেচাকেনা করা যাবে না। অর্থাৎ খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা যখন পাইকারদের কাছ থেকে তেল কিনবেন, তখন সেটির প্রকৃত মূল্য পাকা রসিদে লিখে নিতে হবে। বাজার মনিটরিংয়ে নিয়োজিত ভ্রাম্যমাণ আদালত কিংবা সরকারি অন্যান্য সংস্থা এই রসিদ যাচাই করতে চাইলে তা পাইকার কিংবা খুচরা ব্যবসায়ীদের তৎক্ষণাৎ দেখাতে হবে। এমনকি ভোক্তারা যদি প্রকৃত মূল্য যাচাই-বাছাই করতে চান, তাহলে তা দেখাতে বাধ্য থাকবেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।
তেলের মূল্য নিয়ন্ত্রণে আয়োজিত এ বৈঠক শেষে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, আগামী শুক্রবার থেকে ভোজ্যতেল কেনাবেচায় পাকা রসিদ ছাড়া কোনো ব্যবসা করা যাবে না। রমজান পর্যন্ত চাহিদা মেটাতে দেশে পর্যাপ্ত তেল মজুত আছে। সংকটের ধোঁয়াশা সৃষ্টি
করে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, বিপণন ব্যবস্থায় কারো অনিয়ম কোনোভাবেই মেনে নেয়া হবে না। দেশে পর্যাপ্ত ভোজ্যতেল মজুত থাকলেও যারা কৃত্রিম সংকট বানিয়ে দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর মূল ক্রীড়নক কারা- বৈঠকে এ বিষয়েও আলোচনা হয়। এ প্রসঙ্গে পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, সরবরাহ বন্ধ রেখে মূল কারসাজিতে জড়িত মিলাররা। আর এতে তাল দিচ্ছেন কিছু অসাধু ডিলার। একজন ব্যবসায়ী প্রতিনিধি অভিযোগ করেন, মিল বিগত এক মাস আমাদের কাছে কোনো সয়াবিন তেল বিক্রি করেনি। তাই আপনাদের অনুরোধ, আপনারা আগে সরবরাহটা ঠিক করেন।
সভায় পাইকারি ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা মিল থেকে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিতে যৌথ মনিটরিং টিম গঠনের দাবি জানান। তারা বলেন, দেশে বেশি মিল নেই। ৫ থেকে ৬টি রয়েছে। মিল গেটে ভোক্তা অধিদপ্তরের লোক থাকবে, এফবিসিসিআইর লোক থাকবে এবং প্রয়োজনে ব্যবসায়ীদের লোকও রাখতে পারেন। আমরা সেখানে দেখব কোন মিল কতটুকু তেল সরবরাহ করছে।
দেশে ভোজ্যতেলের বাজার প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে প্রধানত পাম অয়েল ও সয়াবিন তেল আমদানি করা হচ্ছে। এর মধ্যে পাম অয়েল পরিশোধিত অবস্থায় এনে বাজারজাত হচ্ছে। অন্যদিকে সয়াবিন তেল অপরিশোধিত (ক্রুড) অবস্থায় এনে দেশে পরিশোধন করে বাজারজাত করছেন উদ্যোক্তারা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বড় হয়ে ওঠা ভোজ্যতেলের বাজারে এখন নেতৃত্ব দিচ্ছে টি কে গ্রুপ, সিটি, এস আলম ও মেঘনা গ্রুপ। সম্প্রতি বসুন্ধরা গ্রুপও ভোজ্যতেল আমদানি করে বাজারজাতকরণ শুরু করেছে। এর মধ্যে টি কে গ্রুপ রয়েছে শীর্ষস্থানে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল আমদানি শুল্কায়ন বিবেচনায় নিলে গত এক বছরে ভোজ্যতেল আমদানির ৯০ শতাংশই এ পাঁচ প্রতিষ্ঠানের অধীনে হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব করপোরেট প্রতিষ্ঠানের বাইরে সরকার ব্যবসায়ীদের মাধ্যমেও ভোজ্যতেল আমদানি করে বাজারজাত করতে পারে। এতে বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমতে পারে। পেঁয়াজের ক্ষেত্রে এর একটি বিশেষ সুবিধা পাওয়া গেছে।
এদিকে ভোজ্যতেল বাজারের সিংহভাগ পাম অয়েলের দখলে থাকলেও বাসাবাড়িতে বোতলজাত সয়াবিন তেলের চাহিদাই বেশি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশে ভোজ্যতেল আমদানি হচ্ছে প্রধানত বাণিজ্যিক ও শিল্প সুবিধার ভিত্তিতে। এর মধ্যে শিল্প খাতে দেয়া সুবিধা ভোগ করছে দেশের শীর্ষ কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো শুরুতেই কর পরিশোধ না করে ট্যাংকে রাখা তেল খালাসের সময় ধাপে ধাপে পরিশোধের সুযোগ পায়।
দেশে ভোজ্যতেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। বরং দিন দিন বাজারে অস্থিরতা বাড়ছেই। গত সপ্তাহে বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দাম বাড়ানোর প্রস্তাব সরকারি তরফে প্রত্যাখ্যান হওয়ার পর থেকে বাজারে তৈরি হয় ভোজ্যতেলের কৃত্রিম সংকট। বাজার স্বাভাবিক রাখতে সরকার দফায় দফায় বৈঠক করছে। বিভিন্ন অভিযান চালানো হচ্ছে। এরপরও নিয়ন্ত্রণে আসছে না বাজার।
এ প্রসঙ্গে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, এমন একটি যুদ্ধ চলাকালে দ্রব্যমূল্যের ওপর প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু দেশে যে অবস্থা তৈরি হয়েছে, তা সম্পূর্ণ অবাস্তব। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সরকারের সুস্পষ্ট অবস্থানের ঘাটতি আছে এবং প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের হাতে শুধু বাজারই নয়, সরকারও এক অর্থে জিম্মি বলে আমি মনে করি। তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে দক্ষতা ও যে সৎ সাহসের দরকার, তার ঘাটতির কারণেই দেশের বাজারে বর্তমান অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। আর এজন্য ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সিন্ডিকেটের হাতে মার্কেট জিম্মি হওয়ার কারণেই যে দাম বাড়ছে- এ বিষয়টি পরিষ্কারভাবে সরকার ঘোষণা করতে পারেনি। উল্টো সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিতিশীলতার প্রভাব দেশের বাজারে পড়েছে। অর্থাৎ সরকারের দোদুল্যমানতা বাজার অস্থির হওয়ার অন্যতম কারণ। তিনি বলেন, দ্বিতীয় কারণ হিসেবে আমি মনে করি, বাজার নিয়ন্ত্রণে যেসব নিয়ন্ত্রক সংস্থা রয়েছে, তাদের দক্ষতা, স্বচ্ছতার ঘাটতি আছে। অন্যদিকে যারা এসব সিন্ডিকেটের কর্ণধার, তারা কোনো না কোনোভাবে সরকারের প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। যে কারণে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো সৎ সাহস, দৃঢ়তা সরকারের আছে বলে মনে হয় না। সরকার মনে করে, বেশি চাপ সৃষ্টি করলে ব্যবসায়ীরা সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে। এ ধরনের ঝুঁকির মধ্যে সরকার আছে বলেই হয়তো তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
সিন্ডিকেট ঠেকাতে সরকার কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, কনজিউমার প্রোটেকশন আইনে কী বলা আছে, সেই অনুযায়ী অসাধু ব্যবসায়ীদের শাস্তি দেয়া যায় কিনা, তা ভেবে দেখা উচিত। এছাড়া সরবরাহকারীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। সরকার নতুন নতুন উদ্যোক্তাদের এ বিষয়ে আকৃষ্ট করতে পারে। আরো একটি উপায় হচ্ছে, টিসিবির মাধ্যমে চলমান কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে।
ভোজ্যতেল আমদানিতে ভ্যাট প্রত্যাহার চলতি সপ্তাহে : চলতি সপ্তাহে দেশে ভোজ্যতেল আমদানির ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক তথা ভ্যাট) প্রত্যাহারের ঘোষণা আসতে পারে। এ নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট বিভাগ কাজ করছে। বাজারে এরই মধ্যে সয়াবিন তেলের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে এবং পবিত্র রমজান মাস আসছে- এমন প্রেক্ষাপটে বাজার স্থিতিশীল রাখতে ভ্যাট প্রত্যাহার করা হতে পারে। ভ্যাট প্রত্যাহারের সুপারিশ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় স¤প্রতি এনবিআরকে চিঠি দিয়েছে। এনবিআরের ভ্যাট বিভাগ এখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধ বিশ্লেষণ করছে। বর্তমানে আমদানি ও উৎপাদন বা ব্যবসায়িক দুই পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ রয়েছে। দুই পর্যায়েই ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। সেজন্য আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট কমানো হতে পারে বলে এনবিআরের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে।