আজ- বৃহস্পতিবার, ১০ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৫শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Shotto Barta Logo

শিরোনাম

যুদ্ধের বাজারেও সিন্ডিকেট!

সত্যর্বাতা ডেস্ক  :

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়াচ্ছে অসাধু চক্র , বাজারে সরকারের মনিটরিং দুর্বল, ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহব্বান ।

 

 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে রাজধানীর বাজারে। নিত্যপণ্যের দাম যখন রেকর্ড ছাড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত, ঠিক তখনই যুদ্ধসহ নানা অজুহাতে ভোজ্যতেলের দাম আরেক দফা বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও আমদানিকারকরা। এরই মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিলেও তাতে সাড়া মিলেনি। এতে বাজারে দেখা দিয়েছে সয়াবিন তেলের সরবারহ সংকট।

 

 

 

মিলমালিক-পাইকার থেকে শুরু করে খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা বাজার থেকে ভোজ্যতেল সরিয়ে ফেলে সুবিধাজনক স্থানে মজুত করছেন। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম আরো বাড়তে পারে এ আশা থেকে সর্বত্র তেলের মজুত বাড়ানো হচ্ছে। বোতলজাত সয়াবিনের লিখিত মূল্য (এমআরপি) ঘষে তুলে ফেলছেন ব্যবসায়ীরা। সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে প্রতিটি পাঁচ লিটারের বোতল বাজারভেদে ৮০-১২০ টাকা বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। খুচরা পর্যায়ে পাঁচ লিটারের সয়াবিনের বোতল ৮৭০-৯১০ টাকায় বিক্রি হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আবার অনেক দোকানে তেলই পাওয়া যাচ্ছে না। খোলা সয়াবিনের দাম বেশি হওয়ায় কোথাও কোথাও বোতল খুলে বাড়তি দামে তেল বিক্রি করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে ঢাকাসহ সারাদেশে ভোজ্যতেলের বাজারে ব্যবসায়ীদের চরম নৈরাজ্য চলছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কয়েক দিন ধরে অভিযান চালাচ্ছে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর, কিন্তু এরপরও কারসাজি বন্ধ হচ্ছে না। মোটকথা, রমজানের এক মাস আগেই অসাধু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কাছে অসহায় হয়ে পড়ছেন সাধারণ ভোক্তারা। রমজান মাসে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন অনেকেই।

 

 

সপ্তাহখানেক আগে থেকে খুচরা ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছিলেন, খোলা এবং বোতলজাত তেলের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে কোম্পানিগুলো। এতে করে বাজারে তেলের সংকট তৈরি হয়েছে। অর্ডার দিয়েও চাহিদামতো তেল পাওয়া যাচ্ছে না। মালিবাগ রেলগেট বাজারের মুদিপণ্যের ব্যবসায়ী রফিকুল গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, খোলা ভোজ্যতেলের দাম বেশি। এ কারণে অনেক দোকানদারই পাঁচ লিটারের বোতলকেটে তেল বের করে তা খোলা হিসেবে করে বিক্রি করছেন। এতে তাদের ১৫০-২০০ টাকার বেশি মুনাফা হচ্ছে। বাজারে এখন প্রতিলিটার খোলা পামওয়েল ১৯০-২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সয়াবিনের এক লিটারের বোতলও বিক্রি হচ্ছে প্রায় একই দামে।

 

এদিকে তেলের দামের প্রভাব পড়েছে পেঁয়াজের বাজারেও। গতকাল শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মালিবাগ কাঁচাবাজার ও শান্তিনগর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত সপ্তাহে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া পেঁয়াজের দাম বেড়ে এখন ৬০-৭০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। কোনো কোনো ব্যবসায়ী বাছাই করা পেঁয়াজের কেজি ৭৫ টাকা বিক্রি করছেন। কারওয়ান বাজারের বিক্রেতা মনির হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, এবারে শীতের শেষ সময়ে ভারি বৃষ্টি হওয়ায় পেঁয়াজের কাক্সিক্ষত ফলন হয়নি। যে কারণে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। এছাড়া রোজার মাস উপলক্ষে অনেকের মধ্যেই বেশি করে পেঁয়াজ কেনার প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি। যদিও এ বছর আগেভাগেই সবকিছুর দাম একটু বেশি। আমরাও হতাশ, কারণ দাম বাড়লে বেচাকেনা ভালো হয় না।

 

 

 

 

শুধু তেল বা পেঁয়াজ নয়, বেশ কয়েকটি সবজির দামেও চলছে অস্থিরতা। গত সপ্তাহে ১৫ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া আলুর কেজি এখন বিক্রি হচ্ছে ১৮ টাকা। এ তালিকায় আরো রয়েছে টমেটো। গত সপ্তাহে ৪০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া পাকা টমেটোর দাম বেড়ে এখন ৬০-৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চাল ও ডালের দামের ঊর্ধ্বমুখী ধারাও অব্যাহত রয়েছে।
অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে বাড়তে শুরু করেছে গমের দাম। মঙ্গলবার বিশ্ববাজারে খাদ্য পণ্যটির দাম বেড়েছে ৫ শতাংশের ওপরে। এর জেরে দেশের বাজারে কেজিপ্রতি ২ থেকে ৪ টাকা বেড়ে খোলা আটার কেজি এখন ৩০ থেকে ৩২ টাকা, প্যাকেট আটা ৩৪ থেকে ৩৫ টাকা, খোলা ময়দা ৩৫ থেকে ৩৮ টাকা ও প্যাকেট ময়দা ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে হয়েছে।

 

 

 

বাজার পরিস্থিতি নিয়ে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, বাজারে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্বের একটি প্রভাব তো রয়েছেই। আগামীতে এ প্রভাব আরো বাড়বে বলে মনে হচ্ছে। সেটার আশঙ্কার সুযোগ অনেকেই নিচ্ছে। এজন্য সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে, প্রয়োজনে সরবরাহ আরো বাড়ানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তিনি আরো বলেন, সিন্ডিকেট যেন না বাড়ে, কোন ধরনের আঁতাত করে বাজারের এ শঙ্কার সুযোগ যেন কেউ নিতে না পারে- এজন্য নজরদারি বাড়াতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানিকৃত পণ্যের দাম ইতোমধ্যে বাড়তে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে ডলারের সঙ্গে টাকার যে বিনিময় হার, এটাকে স্থিতিশীল রাখতে হবে। সরকারের আমদানি শুল্ক প্রয়োজনে কিছুুটা সমন্বয় করা যেতে পারে। এগুলোর মাধ্যমে মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দেয়া উচিত। কারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ওপর দ্রব্যমূল্যের প্রভাব পড়ছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, সরকারের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় যেসব বিষয় রয়েছে এগুলোকে শক্তিশালী করে প্রান্তিক জনগণকে সুরক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

 

 

 

এ প্রসঙ্গে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, অনবরত বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। তবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব দেশের বাজারে এত তাড়াতাড়ি পড়ার কথা নয়। কারণ, যেসব পণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে তা এখন কেনা হয়নি। অন্তত, একমাস আগেই এর এলসি খুলে আমদানি করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে, এটা অস্বীকার করার কিছু নেই। তবে যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে সেসব পণ্যের আমদানিকারকের সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। তাই চিহ্নিত করাও সহজ। তিনি আরো বলেন, সরকার সিন্ডিকেট বন্ধে নানাভাবে চেষ্টা করছে- এটা আমরা বুঝতে পারছি। কিন্তু জরিমানা করেই এসব সিন্ডিকেট বন্ধ করা যায় কিনা তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে, সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখা। দাম বাড়লেও বাজার থেকে যেন পণ্য উধাও হয়ে না যায়- তা নিশ্চিত করতে হবে।
জানা গেছে, ভোজ্যতেলের বাজারে নৈরাজ্য বন্ধে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর সারাদেশে অভিযান পরিচালনা করছে। ভোজ্যতেল নিয়ে অনিয়মের কারণে ইতোমধ্যে সারাদেশে প্রায় দেড় শতাধিক প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছে সংস্থাটি। এর পাশাপাশি সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা, ডিজিএফআই, এনএসআই, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য এজেন্সিগুলো বাজারের দিকে নজর রাখছে। ভোজ্যতেল নিয়ে যে কারসাজি হচ্ছে- তা স্বীকার করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। এছাড়া জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরও মনে করছে ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা এবং মজুত বাড়িয়ে সরবরাহ কমিয়ে দেয়ায় বাজারে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় অভিযান পরিচালনা করার কোনো বিকল্প নেই সরকারের সামনে। কেননা, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার অজুহাতে সয়াবিন তেলের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে রিফাইনারি কোম্পানিগুলো। ফলে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতি তেলের দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

 

 

 

সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সব রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ভোজ্যতেলের আমদানি ও রিফাইনের পরিমাণ জানতে চেয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তারা গত তিন মাসে কী পরিমাণ আমদানি করেছে, কত পরিমাণ পরিশোধন করেছে, তা কাস্টমস পেপারসহ আগামী সোমবারের মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে। এছাড়া তারা কত পরিমাণের ডিও এবং এসও দিয়েছে, কত ডেলিভারি করেছে এবং কত মজুত আছে, সেটাও জানতে চাওয়া হয়েছে। তথ্য পাওয়ার পর প্রতিটি রিফাইনারিতে ভোক্তা অধিকার অভিযান চালাবে বলে জানা গেছে।
তথ্য মতে, ভোজ্যতেলের বাজারের ৮০-৮৫ শতাংশই খোলা তেলের। বাকি ১৫-২০ শতাংশ বোতলজাত করে বিক্রি হয়ে থাকে। এর পুরোটাই সয়াবিন। পামওয়েল, সুপার পামওয়েল ও বনস্পতি সাধারণত খোলা অবস্থায় বিক্রি হয়ে থাকে।

শেয়ার করুন :

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

এই রকম আরোও খবর