আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রার্থী ঘোষণার পর তৃণমূল থেকে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভের মুখে পড়ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। এই পরিস্থিতি দলটির সামনে নতুন এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গত ৩ নভেম্বর ২৩৭টি আসনের প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর থেকেই প্রায় তিন ডজন আসনে স্থানীয় নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ করছেন। সেসব আসনে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীদের মনোনয়নের দাবিতে চলছে এসব বিক্ষোভ।

তালিকা চূড়ান্ত করার আগে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা জেলা পর্যায়ের হাজারো নেতার সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং তারা দলীয় সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু, এখন অনেকেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশ অমান্য করে বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছেন।

এরই মধ্যে বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার অভিযোগে দুই জেলায় বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের অন্তত ৯ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রার্থীদের বিষয়ে তৃণমূলের গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করতে বিএনপি কিছু স্বাধীন সংস্থাকে কাজে লাগিয়েছে।

৩ নভেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত ২৬ জেলায় অন্তত ৩৮টি বিক্ষোভ ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, এমনকি বিএনপি কর্মীরা সড়ক ও রেলপথও অবরোধ করেছেন। মেহেরপুর, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহে অন্তত ৩০ জন বিএনপি কর্মী আহত হয়েছেন।

প্রার্থী ঘোষণার পরদিন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনোনয়ন না পাওয়া নেতাদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে বলেন, তাদেরকে দল 'যথাযথ সম্মান ও দায়িত্ব' দেবে।

দলীয় অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়, তারেক রহমানের নেতৃত্বাধীন টিমের করা পাঁচটি জরিপের ভিত্তিতে মনোনয়ন তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এরপর শীর্ষ নেতারা মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। গত সেপ্টেম্বরে বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে হাজারো তৃণমূল নেতাকে নিয়ে হওয়া এক বৈঠকে সবাই দলের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, স্বচ্ছ ও ন্যায্য মনোনয়ন প্রক্রিয়ার অভাবেই এই অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে।

তারা সতর্ক করে বলেছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে নির্বাচনে বিএনপির ফলাফলের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও তৃণমূল পর্যায়ের সংগঠকদের মধ্যে দুর্বল যোগাযোগ ও সমন্বয়ের অভাব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

তিনি বলেন, 'তারেক রহমান ঢাকায় না থেকে ভার্চুয়ালি নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। ফলে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আসেনি। এ ধরনের বিষয়ে মুখোমুখি আলোচনা খুবই জরুরি।'

তিনি আরও বলেন, দলটি নির্বাচন আইন (আরপিও) অনুযায়ী কিছু বিধান উপেক্ষা করেছে। এর ফলে ক্ষোভ আরও বেড়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, তারা বিতর্কিত মনোনয়নগুলো পর্যালোচনা করছে এবং প্রক্রিয়া শেষ হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি ক্ষুব্ধ স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঐক্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।

তিনি বলেন, 'যেসব জেলায় বিক্ষোভ হচ্ছে, সেখানে জেলা নেতাদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আমরা ইতোমধ্যেই মনোনয়ন পরিবর্তনের কয়েকটি আবেদন পর্যালোচনা করেছি। খুব শিগগির পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হবে এবং যারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

সাতক্ষীরায় প্রার্থী ঘোষণার পর টানা চতুর্থ দিনও বিক্ষোভ অব্যাহত ছিল। স্থানীয় নেতাকর্মীরা বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য শহিদুল আলমকে সাতক্ষীরা-৩ আসনে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন।

বিক্ষোভকারীরা সড়ক ও মহাসড়ক অবরোধের পাশাপাশি ৪ নভেম্বর অর্ধদিবস হরতালও পালন করেন।

একই ধরনের বিক্ষোভ হয়েছে মাদারীপুর, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, মেহেরপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও নাটোরেও।

ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলায় বিএনপির প্রার্থী এম ইকবাল হোসেন ও মনোনয়ন না পাওয়া তায়েবুর রহমান হিরণের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে এক ছাত্রদল কর্মী মারা যান এবং অন্তত আটজন আহত হন। এ ঘটনায় ৫ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

কুমিল্লায় এক রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ঘিরে আবুল কালাম ও সামিরা আজিম দোলার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন আহত হন।

গাইবান্ধায় মনোনীত প্রার্থী ফারুক আলম ও স্থানীয় নেতা নাহিদুজ্জামান নিশাতের সমর্থকদের মুখোমুখি সংঘর্ষ ঠেকাতে প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। চট্টগ্রামে আসলাম চৌধুরীর সমর্থকরা চট্টগ্রাম-৪ আসনে কাজী সালাহউদ্দিনের মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও রেললাইন অবরোধ করেন।

একই ধরনের ঘটনার খবর এসেছে কুষ্টিয়া, রংপুর, টাঙ্গাইল, মাগুরা, নাটোর, নওগাঁ, মুন্সিগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, জয়পুরহাট, সিলেট, ফরিদপুর, রাজশাহী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকেও।

মনোনয়ন ঘোষণার পরদিন প্রার্থিতা স্থগিত করা হয় মাদারীপুরে বিএনপি নেতা কামাল জামানের। তার সমর্থকরা ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে বিক্ষোভ করে প্রার্থিতা পুনর্বহালের দাবি জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মজিবুর রহমান বলেন, শৃঙ্খলা ফেরাতে বিএনপিকে আরও কঠোর অবস্থান নিতে হবে।

তিনি বলেন, 'দলীয় অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা দলের মধ্যেই সমাধান করতে হবে। সেটা যেন জনদুর্ভোগের কারণ না হয়।'