রংপুর অঞ্চলের কৃষকরা এ বছর আগের চেয়ে আরও বেশি জমিতে তামাক চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গত মৌসুমে অপ্রত্যাশিতভাবে ভালো দাম পাওয়ায় তাদের আগ্রহ বেড়েছে। দেশি-বিদেশি সাতটি তামাক কোম্পানির প্রতিনিধিরা কৃষকদের আরও বেশি জমিতে তামাক চাষে উৎসাহিত করছেন। তারা কৃষকদের বিনা মূল্যে বীজ, সার, কীটনাশক এবং সুদবিহীন ঋণ সুবিধা দিচ্ছেন।

তবে কৃষি বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, এই 'বিষাক্ত ফসলের' চাষ বেড়ে যাওয়ায় শীতকালীন সবজি, সরিষা, গম ও ধানের চাষ হুমকির মুখে পড়ছে। এতে মাটির উর্বরতা, পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) তামাক চাষ কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার হারাগাছ এলাকার কৃষক মকবুল হোসেন (৫৫) বলেন, 'গত বছরের তুলনায় এ বছর আরও বেশি জমিতে তামাক চাষের প্রস্তুতি চলছে। গত বছর ছয় বিঘা জমিতে চাষ করেছিলাম, এ বছর আরও দুই বিঘা জমি বাড়িয়েছি। বীজতলা প্রস্তুত করেছি, নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে চারা রোপণ শুরু করব।'

লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার সেনপাড়া গ্রামের কৃষক গজেন্দ্রনাথ সেন (৫৮) বলেন, 'গত বছর চার বিঘা জমিতে ৩৩ মণ তামাক উৎপাদন করেছিলাম। প্রতিমণ ৮,৪০০ টাকায় বিক্রি করে মোট ২ লাখ ৭৭ হাজার টাকা পেয়েছিলাম। উৎপাদনে খরচ হয়েছিল ৮২ হাজার টাকা। এ বছর আট বিঘা জমিতে তামাক চাষের প্রস্তুতি নিয়েছি। কোম্পানির লোকজন জানিয়েছে, এ বছর দাম আরও বাড়বে এবং বিক্রিতে কোনো জটিলতা হবে না।'

একই গ্রামের কৃষক বিশ্বনাথ চন্দ্র সেন (৬০) বলেন, 'জানি তামাক চাষ মাটি, পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, তবুও আমরা বাধ্য হয়ে চাষ করি। কারণ কোম্পানিগুলো আমাদের সব দেয়—বীজ, সার, কীটনাশক ও ঋণ। লাভের আশাতেই আমরা চাষ চালিয়ে যাচ্ছি।'

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুর গ্রামের কৃষক সাইদুল ইসলাম (৬০) বলেন, 'আমাদের গ্রামে এ বছর তামাক চাষিদের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় অনেক বেড়েছে। সাধারণত উর্বর জমিতেই তামাক চাষ হয়। তামাকের জমি বাড়ার কারণে সবজি, গম, সরিষা ও ধানের জমি দিন দিন কমে যাচ্ছে।'

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত বছর রংপুর অঞ্চলে ১৯ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছিল। এর মধ্যে ১৩ হাজার ৫০০ হেক্টর লালমনিরহাটে, আর আদিতমারী উপজেলাতেই ছিল ৭ হাজার ৩০০ হেক্টর। বর্তমানে রংপুর অঞ্চলে প্রায় ৪৩ হাজার কৃষক তামাক চাষের সঙ্গে জড়িত।

অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্স (আত্মা))-এর সদস্য খোরশেদ আলম বলেন, 'অধিদপ্তর যা তথ্য দেয় তার দ্বিগুণ জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। এ বছর আরও বেশি জমিতে তামাকের প্রস্তুতি চলছে। যদি কোম্পানিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ না করা যায়, তামাক চাষ ক্রমেই বাড়তে থাকবে।'

অভিযোগের ব্যাপারে তিনটি প্রধান তামাক কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা কোম্পানির গোপনীয়তার অজুহাতে কথা বলতে রাজি হননি।

লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা ওমর ফারুক বলেন, 'গত বছরের তুলনায় এ বছর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেশি জমিতে তামাক চাষ হতে পারে। অনেক কৃষক সবজি, সরিষা ও গম চাষ ছেড়ে তামাকের দিকে ঝুঁকছেন। কোম্পানিগুলো সরাসরি কৃষকদের উৎসাহ দিচ্ছে এবং আর্থিক সহায়তাও দিচ্ছে। আমরা কৃষকদের সচেতন করার চেষ্টা করছি, কিন্তু তারা সাময়িক লাভের আশায় আমাদের কথা শোনেন না।'

রংপুর অঞ্চলের ডিএই-এর অতিরিক্ত পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, 'তামাক চাষ কমানোর জন্য কৃষকদের সচেতন করতে কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। কোম্পানিগুলো যাতে সরাসরি কৃষকদের প্রভাবিত করতে না পারে, সে বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'বিধান না থাকায় আমরা সরাসরি তামাক কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছি না। তামাক চাষে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়, যা মাটি, পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।'