ব্রাজিলের বেলেম শহরে কপ৩০ জলবায়ু সম্মেলনে মিলিত হতে যাচ্ছেন বিশ্বনেতারা। সেখানে তারা কার্বন নিঃসরণ কমানো, জলবায়ু অভিযোজন ও অর্থায়নের বিষয়ে বৈশ্বিক রূপরেখা ঠিক করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব ইতোমধ্যেই আমাদের ঘরের দুয়ারে আঘাত হানছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী অঞ্চলে প্রান্তিক কৃষকেরা এখন অনিয়মিত বর্ষা, বাড়তি তাপমাত্রা ও পানি সংকটের সঙ্গে লড়ছেন। জলবায়ুর এই অস্থিরতা ফসল নষ্ট করছে এবং ভবিষ্যৎকে করে তুলছে অনিশ্চিত। সরেজমিনে ঘুরে এসে এ বিষয়ে প্রতিবেদন করেছেন পিনাকী রায়

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার সাঁওতাল কৃষক কংগ্রেস টুডু তার আমন ধানের খেত দেখাচ্ছিলেন। ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া জমির দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, 'সপ্তাহখানেক সেচ না পেলে মাটি শুকিয়ে এমন ফেটে যায়।'

দু-একদিনের মধ্যে সেচ দিতে না পারলে বেশিরভাগ ধান গাছ চিটা হয়ে যাবে, দানা ধরবে না বলে জানান এই কৃষক।

অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে কংগ্রেস টুডু টাকার অভাবে সেচ দিতে পারেননি। ৫৫ বছর বয়সী এই কৃষক জানান, এ বছর বৃষ্টি গত বছরের চেয়ে একটু বেশি হয়েছে। কিন্তু তারপরও প্রতি সপ্তাহেই জমিতে সেচ দিতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, 'আমাদের এলাকায় অনেক কৃষক খুবই গরিব। বার্ষাপাড়া গ্রামের এক সাঁওতাল কৃষক ২০২৩ সালে ধানখেতে সেচ দিতে না পেরে হতাশায় কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।'

তার আগের বছর পাশের গ্রামের দুই সাঁওতাল কৃষক—অভিনাথ মার্ডি ও রবি মার্ডি আত্মহত্যা করেন। তাদের পরিবার জানায়, এক নলকূপ মালিক তাদের পানি দিতে অস্বীকার করেছিলেন।

তানোর উপজেলার কৃষক মো. সেলিম মিয়া বলেন, 'আমাদের নলকূপ ৪০ ফুট গভীর। এখন আর পানি উঠছে না। এখন আমাদের নতুন গভীর নলকূপ বসাতে হবে। আমরা সবাই ভূগর্ভস্থ পানির ওপরই নির্ভরশীল।'

তানোর ও গোদাগাড়ী—দুই উপজেলা মিলে বরেন্দ্র অঞ্চল, যাকে একসময় বলা হতো বাংলাদেশের "ধানের ভাণ্ডার"।

আশির দশকের মাঝামাঝি সময়েও এই অঞ্চল ছিল অনুর্বর, যেখানে ভূ-পৃষ্ঠের পানি ছিল খুবই সীমিত।

নব্বইয়ের দশকে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) গভীর নলকূপ বসালে কৃষকেরা বছরে তিনবার ফসল ফলাতে সক্ষম হন। কিন্তু এখন এই অঞ্চল ভয়াবহ সংকটে পড়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে, তাপমাত্রা বাড়ছে আর বৃষ্টির ধরনও বদলে গেছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সরওয়ার বলেন, 'জলবায়ু পরিবর্তন এখানে নীরব ঘাতক।'

তিনি জানান, রাজশাহী অঞ্চলে গড় বৃষ্টিপাত বছরে ১ হাজার ২৩৫ মিলিমিটার, যেখানে সারাদেশের গড় ২ হাজার মিলিমিটার।

তিনি বলেন, 'আপনি যদি এই এলাকায় আসেন, দেখবেন প্রচুর ফসলের মাঠ ও ফলের বাগান। বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যায় না খরার ভয়াবহতা। যতটুকু উৎপাদন হচ্ছে, সবই ভূগর্ভস্থ পানি খরচ করে।'

যে আমন ধান আগে শুধু বর্ষার পানিতে জন্মাতো, এখন সেটিতেও নিয়মিত সেচ দিতে হয় বলে জানান এই অধ্যাপক।

রাজশাহীর মতো নওগাঁ জেলার সাপাহার উপজেলাও ভয়াবহ পানি সংকটে ভুগছে। স্থানীয় কৃষক ইমদাদুল হক বলেন, 'আগের মতো এখন আর বৃষ্টি হয় না। ভূগর্ভস্থ পানি ক্রমেই নিচে নামছে। কখনো কখনো গভীর নলকূপ থেকেও পানি ওঠে না।'

তিনি বলেন, 'গভীর করে খুঁড়লেও বেশিরভাগ জায়গায় শুধু লালচে মাটি পাওয়া যায়, পানি নেই। দশ বছর আগেও ৩০ ফুট খুঁড়লেই পানি পাওয়া যেত। এখন ৮০ ফুট পর্যন্ত খুঁড়তে হয়।'

এই পরিস্থিতিতে সরকার গত আগস্টে চার জেলার ২৬টি উপজেলার ৫০টি ইউনিয়নকে 'তীব্র পানি সংকটপূর্ণ এলাকা' হিসেবে ঘোষণা করেছে।

এর মধ্যে ৪৭টি ইউনিয়ন রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলায় এবং বাকি ৩টি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায়। সরকার এখন এসব এলাকায় পানির ব্যবহার সীমিত করার জন্য নতুন নির্দেশিকা প্রস্তুত করছে।

বৃষ্টিপাতের ধরনে বড় পরিবর্তন

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের (বিএমডি) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, উত্তরাঞ্চলে বৃষ্টিপাত ক্রমাগত কমছে।

গবেষণাটি জানায়, রাজশাহী বিভাগে প্রতি দশকে বৃষ্টিপাত গড়ে ৫৪ মিলিমিটার করে কমছে। ১৯৮০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত সময়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ ফল পাওয়া গেছে।

আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, 'এখন বর্ষাকালে বৃষ্টি কম, কিন্তু বর্ষার পর হঠাৎ ভারী বৃষ্টিপাত বেড়েছে।'

ভূতত্ত্ববিদদের মতে, প্রায় ৭ হাজার ৭৭০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে থাকা বরেন্দ্র অঞ্চল মূলত শক্ত মাটির (হার্ড ক্লে) উপর গঠিত, যা বৃষ্টির পানি ধারণ করতে পারে না।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বিডব্লিউডিবি) সাবেক পরিচালক আনোয়ার জাহিদ বলেন, 'এই অঞ্চলের মাটির নিচে ২০০ থেকে ৮০০ ফুট পর্যন্ত কোনো বালির স্তর নেই, যা পানি ধারণ করতে পারে। পুরোটা জুড়ে কেবল শক্ত মাটি।'

তিনি জানান, 'উত্তরাঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর গত ৫০ বছরে প্রায় ৮০ মিটার নিচে নেমে গেছে। বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানি পুনরায় পূরণ হচ্ছে না। একই সঙ্গে পুকুর-খালসহ ভূপৃষ্ঠের পানিও শুকিয়ে যাচ্ছে।'

২০২২ সালে তার নেতৃত্বে করা বিডব্লিউডিবির এক গবেষণায় ১৯৭০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৫০ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। তাতে দেখা যায়, অন্তত ৩৮ জেলায় শুষ্ক মৌসুমে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের কারণে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে।

বাড়তি তাপমাত্রা ও এর প্রভাব

বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ার ফলে তাপমাত্রাও ক্রমাগত বাড়ছে। এর ফলে কীটপতঙ্গের আক্রমণ বাড়ছে এবং ফসলের পরাগায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানান কৃষি বিশেষজ্ঞরা।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের গবেষণায় বলা হয়েছে, গত বছরের বর্ষাকালে দেশের আটটি বিভাগেই সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বেড়েছে। এর মধ্যে খরাপ্রবণ রাজশাহীতে তাপামাত্রা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে—প্রতি দশকে গড়ে শূন্য দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

রাজশাহীর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (ফসল) শারমিন সুলতানা বলেন, 'তাপমাত্রা বাড়ায় পোকামাকড়ের প্রজনন বেড়েছে। এতে ফসলের উৎপাদন কমছে।'

তিনি আরও বলেন, 'তাপমাত্রা বাড়লে এক ধরনের পোকার আক্রমণ বেড়ে যায়, স্থানীয়ভাবে যাকে বাদামি ঘাসফড়িং বলা হয়। এদের দমন করতে কৃষকদের কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়, যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি।'

রাজশাহীতে মার্চ মাস থেকেই গরম বাড়তে শুরু করে। গড় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়ালে বোরো ধানের পরাগায়ন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় বলে জানান শারমিন সুলতানা।

'তাপমাত্রা বাড়লে ভূগর্ভস্থ পানি আরও নিচে নেমে যায়, ফলে সেচ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আবার মে মাসে তীব্র গরমে অনেক কৃষক ধান কাটা বা মাঠে কাজ করার সময় হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হন।'

(এই প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন রাজশাহী সংবাদদাতা সোহানুর রহমান রাফি)