'নিজেরাই খাইতে পারি না, বাচ্চাগো খাওয়ামু কী!'—সন্তানের পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে কি না জানতে চাইলে এই জবাব দেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ি বস্তির বাসিন্দা শিল্পী আক্তার।

তিন সন্তানের এই মা বলেন, বাসা-বাড়িত কাম কইরা ৩ হাজার টাকা পাই। তিন বেলা ভাতের লগে খাওনের লাইগা শাকই ঠিক মতো জুটেনা, বাচ্চাগো পুষ্টির খাওন দিমু কই থেইকা?'

শিল্পীর সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন তিনি কাঁচা বাজার কুড়িয়ে আনা হেলেঞ্চা শাক পরিষ্কার করছিলেন। দুপুরে ভাতের সঙ্গে এই শাকই একমাত্র তরকারি। পাশেই খেলা করছিল তার দুই সন্তান। দুজনের শরীরই শীর্ণ, কিন্তু পেট স্ফীত—পুষ্টিহীনতার স্পষ্ট লক্ষণ। শিল্পী জানালেন, গত সপ্তাহেই তার ছোট ছেলে পেটের অসুখে ভুগেছে।

এটি ঢাকার একটি বস্তির বিচ্ছিন্ন চিত্র নয়। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) তথ্যমতে, রাজধানীতে প্রায় পাঁচ হাজার বস্তিতে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ বাস করে, যাদের প্রায় ১৬ লাখই শিশু। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, এসব শিশুর বেশির ভাগই পুষ্টিহীনতায় ভুগছে।

আর্থিক সংকট ও সচেতনতার অভাবে পুষ্টিহীনতার শিকার এসব শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কমে যাচ্ছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, যা ভবিষ্যতের জন্য বড় হুমকি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

চলতি বছরের জুলাই মাসে আইসিডিডিআরবির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বস্তিতে বাস করা ৫০ শতাংশ শিশু স্বাভাবিকের তুলনায় খর্বাকৃতির হয়। এদের ২৭ শতাংশের উচ্চতা কম এবং ২০ শতাংশের ওজন কম।

গবেষক দলের প্রধান মোস্তফা মাহফুজ ডেইলি স্টারকে বলেন, পুষ্টির অভাবে বস্তির শিশুদের শারীরিক ও মানসিক দুরাবস্থার চিত্র উঠে এসেছিল ইউনিসেফ ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত একটি যৌথ জরিপেও।

এর আগে ইউনিসেফ ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৬ সালের সেই যৌথ জরিপে বলা হয়, সিটি করপোরেশন এলাকার বস্তিতে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ৪০ শতাংশ খর্বকায়, ৩১ শতাংশ কম ওজনের এবং ১২ শতাংশ কৃশকায় বা রোগা, ৮ শতাংশ অধিকতর নাজুক ও ৩ শতাংশ স্থূলকায়।

ডা. মাহফুজ আরও বলেন, বস্তিতে পানি, হাইজিন ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ভীষণ দুর্বল। একইসঙ্গে অপরিষ্কার থাকার দরুন শিশুদের ক্ষুদ্রান্ত্রেও জীবাণু পেয়েছি আমরা। এর ফলে তারা পুষ্টিকর খাবারও খেলেও তা হজম হচ্ছে না। এটা বস্তির শিশুদের স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে এবং শিশুদের ওজন হ্রাস পাচ্ছে। গ্রামে তবুও শিশুরা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে পারছে, শহরে বস্তিবাসীরা কোথায় যাবেন তা জানেন না। কোনো জটিল রোগে আক্তান্ত হলেই তারা সরকারি হাসপাতালে যাচ্ছেন। তাই বস্তির শিশুদের পুষ্টিহীনতা রোধে সমষ্টিক নজরদারী ও উদ্যোগ প্রয়োজন।

মিরপুরের ঝিলপাড় বস্তিতে দুই সন্তানকে নিয়ে থাকেন শিরিন আখতার। তিনি বলেন, বাজারে জিনিসপত্রের যে দাম, তাতে পুষ্টিকর খাবার দেওয়াটা স্বপ্নের মতো। তার স্বামী নুরুল আলম ভ্যান চালান। তিনিই পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। নুরুল বলেন, যা আয় করি, তা দিয়ে বাচ্চাদের পুষ্টিকর খাবার দেওয়া সম্ভব না।

শিরিন জানান, পুষ্টির গুরুত্ব সম্পর্কে জানলেও অর্থাভাবে তিনি সন্তানদের ভালো খাবার দিতে পারেন না। মাসে সর্বোচ্চ এক বেলা মাংস আর দুই বেলা মাছ জোটে তাদের। বাকি দিনগুলোতে থাকে শাক, আলুভর্তা বা ভাজি। কথা বলার সময় দেখা গেল, শিরিনের ১০ বছর বয়সী মেয়ে খাদিজা সকালের পান্তাভাত আর আলুভাজি দিয়ে দুপুরের খাবার খাচ্ছে।

একই চিত্র মিরপুরের ভাসানটেক বস্তিতেও। এখানকার বাসিন্দা রাবেয়া জানালেন, তার তিন সন্তান প্রায়ই অসুস্থ থাকে। মাসে সর্বোচ্চ একবার মাছ আর দুবার ডিম খেতে পায় তারা।

কথা বলে জানা যায়, পুষ্টিকর খাবার সম্পর্কে তার কোন ধারনা নেই।

ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, যেসব শিশু অপুষ্টিতে ভোগে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং তাদের অন্যান্য রোগের সংক্রমণের ঝুঁকিও বেশি। তারা প্রায়শই একাগ্রতার সমস্যায় ভোগে এবং কোনো কিছুতে বেশি মনোযোগ দিতে পারে না। একারনে তাদের পড়ালেখাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বারডেম হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ শামসুন্নাহার নাহিদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শিশুর জন্মের প্রথম দুই বছরেই ৯৫ শতাংশ মেধার বিকাশ ঘটে। পুষ্টিহীনতার কারণে বস্তির শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আবার গর্ভাবস্থায় মায়েরা পুষ্টিকর খাবার না পাওয়ায় তারা নানা জটিলতায় ভুগছে। শুধু অর্থের অভাব নয়, জনসচেতনতার ঘাটতিও এর জন্য দায়ী।

শামসুন্নাহার নাহিদ আরও বলেন, পুষ্টিহীনতার কারণে সাধারণ শিশুদের তুলনায় বস্তির শিশুরা শারীরিক এবং মানসিক—দুভাবেই পিছিয়ে পড়ছে। যার ফলে তারা মানসিক ও শারীরিকভাবে অপরিপক্ব হয়ে বেড়ে উঠছে। পুষ্টিহীনতার কারণে তাদের পরিপূর্ণ কার্যক্ষমতা হারিয়ে যাচ্ছে।

জাতীয় পুষ্টি পরিষদের মহাপরিচালক ডা. মো. রিজওয়ানুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা অনেক দিন ধরেই বস্তির শিশুদের পুষ্টি সংকট সমাধানের চেষ্টা করছি। সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ, ন্যাশনাল নিউট্রিশন সার্ভিস এবং স্থানীয় সরকারের আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রজেক্টের মাধ্যমে মায়েদের পুষ্টি বিষয়ে সচেতন করা হচ্ছে।' তিনি জানান, মাল্টিসেক্টরিয়াল আরবান নিউট্রিশন স্ট্র্যাটেজি (মুনস) অনুমোদন পেলে বস্তির শিশুদের পুরোপুরি পুষ্টি কর্মসূচির আওতায় আনা সম্ভব হবে।