কড়াইল বস্তিতে আজ মঙ্গলবার বিকেলে যখন আগুন লাগে তখন ছোট ঘরে বিছানায় শুয়েছিলেন চলাফেরায় অক্ষম ৪৫ বছর বয়সী বকুল বেগম।

আগুন লাগার পর তিনি আতঙ্কে চিৎকার করতে থাকেন। এক কিশোর শুনতে পায় তার চিৎকার। পরে ওই কিশোর সেখানে গিয়ে ভয়াবহ ওই আগুনের মধ্য থেকে হুইলচেয়ারে বকুলকে বের করে আনে।

বিকেল সোয়া ৫টার দিকে বস্তিতে এ আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিট ঘটনাস্থলে কাজ করলেও রাত ৯টা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে আসেনি ভয়াবহ এ আগুন।

গত প্রায় ২৬ বছর ধরে কড়াইল বস্তিতে থাকেন বকুল বেগম। নয় বছর আগে একটি দুর্ঘটনায় তার কোমর ভেঙে যায়। এরপর থেকে তিনি আর হাঁটতে পারেন না—হুইলচেয়ারই ভরসা। তার পাঁচ সন্তান ওই বস্তিতেই থাকেন।

আজ আগুন লাগার সময় বকুল ছিলেন তার ছোট ছেলের ঘরে। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'যখন আগুন লাগে তখন কী করব বুঝতে পেরে আতঙ্কে চিৎকার শুরু করি। কিছুই করতে পারছিলাম না…শুধু চিৎকার করতেছিলাম।'

তখন পাশের ঘরের ১৪–১৫ বছরের এক কিশোর ছুটে আসে। কিশোরটি নিজেও আতঙ্কে কাঁপছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে প্রতিবন্ধী বকুল বেগমকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
প্রথমে তাকে বিছানা থেকে তুলে হুইলচেয়ারে বসায়, তারপর আগুনের মধ্য দিয়ে হুইলচেয়ার ঠেলে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যায়।

বকুল বেগমের স্বামী বিল্লাল হোসেন রিকশা চালাতেন। ১৭ বছর আগে তাকে ও পাঁচ সন্তানকে ফেলে চলে যান তিনি। তখন বকুলের সন্তানদের সবাই অল্প বয়সী, কারও উপার্জনক্ষমতা ছিল না।

স্বামী চলে যাওয়ার পর বকুল দিনমজুরের কাজ শুরু করেন—মাটি কাটার কাজ, নির্মাণশ্রমিকের কাজ, এমনকি বনানীতে গাছ কাটার কাজও করেছেন। সেই গাছ কাটার কাজ করতে গিয়েই গাছ পড়ে তার কোমর, দুই পা ভেঙে যায়।

এরপরও থেমে যাননি বকুল। হুইলচেয়ারে বসেই সন্তানদের মানুষ করেছেন, তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলে এখন কাছাকাছি ঘরে থাকে। কিন্তু আগুনের ঘটনায় তাদের সবার ঘরই পুড়ে গেছে, সবাই ক্ষতিগ্রস্ত।

আগুন লাগার সময় সন্তানরা ঘরের বাইরে ছিলেন। বকুল ও তার সন্তানদের ঘরের সবকিছু পুড়ে গেছে।

তিনি বলেন, 'স্বামী ছাইড়া গেছে, নিজে কাম করে সংসার চালাইছি। এখনো করতে হয়। আজ আগুনে সব শেষ।'

বকুলের মতো ওই বস্তির শতাধিক পরিবার আজ ঘরহারা হয়ে পড়েছে। 

বকুল বেগমের ছেলের স্ত্রী সুবর্ণা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা সবাই কাজে বাইরে ছিলাম। সবার বাসা আগুনে পুড়ে গেছে। মালামাল বের করতে পারিনি।'

ঘটনাস্থল থেকে ডেইলি স্টারের প্রতিবেদক জানান, ওই বস্তির ঘরগুলো টিন, বাঁশ, কাঠ ও লোহার তৈরি। একতলা, দোতলা, তিনতলা ঘরগুলো আগুনে জ্বলছে। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে বস্তির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

বস্তির বেশিরভাগ বাসিন্দা সাধারণত পোশাককর্মী, রিকশাচালক, হকার বা দিনমজুর। বিকেলে আগুন লাগার সময় তাদের বেশিরভাগই বাড়িতে ছিল না।

সেখানে দেখা যায়, ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের সঙ্গে স্থানীয়রা যে যেভাবে পারছেন চাপকল বা খাল থেকে পানি নিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন।

রাত ৯টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, 'কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভানোর কাজ করছে। বস্তির পূর্ব-উত্তর দিকে আগুন এখনো জ্বলছে। প্রথমে ১৬টি ইউনিট ছিল, এখন প্রায় ২০টি ইউনিট কাজ করছে।'