বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহু বছর ধরে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি হলো—নির্দলীয় নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা। একসময় এটি মুক্ত ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা হিসেবে জনগণের আস্থা অর্জন করেছিল। তবে পরবর্তীতে একতরফাভাবে বাতিল হওয়ায় এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তীব্র বিতর্ক চলেছে। বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট এক ঐতিহাসিক রায় দিয়ে ঘোষণা করেছেন, কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা আবারও সংবিধানে ফিরছে। আদালতের মতে, এই ব্যবস্থা জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার এবং গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য অপরিহার্য। তবে বড় প্রশ্ন এখনো রয়ে গেছে—এই ব্যবস্থা কি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কার্যকর হবে, নাকি তার পরের নির্বাচনে বাস্তবায়িত হবে?

দুটি আপিল ও চারটি রিভিউ পিটিশনের শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রিফাত আহমদের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাতজন বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে ২০১১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের সেই আদেশটিই বাতিল করেছে।

রায়ে সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন, ১৪ বছর আগে আপিল বিভাগের দেওয়া রায়টি 'একাধিক ত্রুটিতে ত্রুটিপূর্ণ' বলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। সেই রায় সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা হলো।

আপিল বিভাগ বলেছে, সংবিধানের চতুর্থ ভাগের পরিচ্ছদ ২ (ক)-এর নির্দলীয় সরকার–সম্পর্কিত বিধানবলি, যা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আইনের ৩ ধারায় সন্নিবেশিত হয়েছিল, এই রায়ের মাধ্যমে তা পুনরুজ্জীবিত ও সক্রিয় করা হলো। 

তবে সর্বোচ্চ আদালত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার–সম্পর্কিত বিধানবলি কেবল ভবিষ্যৎ প্রয়োগ যোগ্যতার ভিত্তিতে কার্যকর হবে। 

দীর্ঘ আন্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকার ১৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনে বাধ্য হয়। ১৯৯৯ সালে একজন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবীসহ কয়েকজন এই সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ রায় দেয় ১৩তম সংশোধনী সাংবিধানিক। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল থাকে।

২০০৫ সালে আবেদনকারীরা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। ২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগ রায় দেয়। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে সাত সদস্যের বেঞ্চ ৪-৩ ভোটে ১৩তম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে।

২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ১৫তম সংশোধনী পাস করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল করে।

৫৮বি(১) অনুচ্ছেদে বলা ছিল, সংসদ ভেঙে দিয়ে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে এবং ৫৮সি(২) অনুচ্ছেদে উল্লেখ ছিল, সংসদ বিলুপ্তির ১৫ দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টা নিয়োগ দিতে হবে।

বিএনপি ও জামায়াতের আইনজীবী এবং সংশ্লিষ্টরা বলেন, সর্বোচ্চ আদালত যেহেতু উল্লেখ করেছে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান 'ভবিষ্যতে কার্যকর হবে', তাই এটি পরবর্তীতে কার্যকর হওয়া উচিত।

বিএনপির আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, 'আদালত বলেছেন, এর কার্যকারিতা প্রস্পেক্টিভলি।'

এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, 'আমরা বলেছিলাম যে বর্তমানে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যারা ইতোমধ্যে ফেব্রুয়ারি ২০২৬ এর মধ্যে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে এবং সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তারা নির্বাচনী প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন।'

'আজকের রায়ের মাধ্যমে এটা স্পষ্টত হয়ে গেল যে, এই নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যেটি আজকে থেকেই সংবিধানে ফিরে এলো, তার অধীনে আসন্ন নির্বাচনটি হবে না।' যোগ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'এই রায়ের কার্যকারিতা হবে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের পরে।'

জামায়াতে ইসলামীর আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, 'রায়ে বলা হয়েছে, অতীতের যে রায় দেওয়া হয়েছে এটি টেইন্টেড, বাংলায় বলে কলঙ্কিত এবং এরর অ্যাপারেন্ট অন দ্য ফেইস অব দ্য রেকর্ড। দেখামাত্রই মনে হয় অতীতের রায়টা ছিল টেইন্টেড।'

'এবং সেইজন্য বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে থার্টিন্থ অ্যামেন্ডমেন্টকে যে আনকনস্টিটিউশনাল ডিক্লেয়ার করা হয়েছিল সেই রায়কে পরিপূর্ণভাবে বাতিল করা হলো ইন ইটস এনটায়ারিটি।'

তিনি বলেন, 'এই রায় ঘোষণার ভিত্তিতে থার্টিন্থ অ্যামেন্ডমেন্ট বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত হলো। ইংরেজিতে বলেছেন, রিভাইভড অ্যান্ড রেস্টোর্ড। এই রিভাইভ এবং রেস্টোর্ডটা কখন কার্যকর হবে, সেটা বলেছেন সাবজেক্ট টু এনফোর্সমেন্ট অব আর্টিকেল ফিফটি এইট বি অ্যান্ড ফিফটি এইট সি।'

'এর অর্থ হলো সংসদ ভাঙিয়ে যাওয়ার ১৫ দিনের ভেতরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে। এখন যেহেতু সংসদ নাই, ভাঙিয়ে যাওয়ার ১৫ দিনের ভেতরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হওয়ার কোনো বিধানও আপাতত কার্যকর হবে না।'

শিশির মনির আরও বলেন, এই রিভাইভাল এবং এই রেস্টোরেশনের আদেশ কার্যকর হবে মাস্ট অপারেট প্রস্পেক্টিভলি। আগামীতে এটি কার্যকর হবে। বর্তমান সময়ে এটি কার্যকর হবে না। অর্থাৎ ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করার ক্ষেত্রে এই যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রিভাইভ হলো, তার কার্যকারিতা থাকবে না। তার কার্যকারিতা থাকবে প্রস্পেক্টিভলি। অর্থাৎ চতুর্দশ সংসদ যে সংসদ নির্বাচন হবে, সেই সময় থেকে।'

পঞ্চদশ সংশোধনী মামলায় আপিল বিচারের অপেক্ষায় আছে; সেখানেও তত্ত্বাবধায়ক ফেরানোর প্রশ্ন আছে, দুই রায় সাংঘর্ষিক হবে কি না প্রশ্ন করা হলে শিশির মনির বলেন, 'পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে অ্যামেন্ডমেন্ট আনা হয়। এই অ্যামেন্ডমেন্টটাকে আমাদের হাইকোর্ট ডিভিশন বাতিল ঘোষণা করেছেন। আংশিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক-সংক্রান্ত পুরাটাকেই বাতিল করেছেন।'

'তার বিরুদ্ধে আপিল দায়ের হয়েছে। লিভ হয়েছে। এই লিভ শুনানির জন্য পেন্ডিং আছে। সাবজেক্ট টু কী ডিসিশন সেখানে হবে, এটার জন্যও অপেক্ষা করার সময় দরকার বলে আমি মনে করি। এটি না হলে একটা জিনিস পরিপূর্ণভাবে সেটেল হবে না। একটা বিতর্ক থেকেই যাবে। সেজন্য ইন ইটস এনটায়ারিটি শেষ করতে পারলে ভালো হতো। আশা করি, ওইটাও দ্রুত নিষ্পত্তি করা হবে।'

এই রায়ের কোনো সমস্যা হবে কি না প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, 'না, ওটার কারণে আজকের রায়ের, আজকের রায় তো তত্ত্বাবধায়ক সরকার সিস্টেমটাকে বাতিল করে যে রায় দিয়েছিলেন, তার রিভিউ করে বাতিল করা হলো। এর মানে কী? তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটা বহাল করা হলে।'