ভারত থেকে ঢাকার আদালতে আইনি জটিলতায় বৃদ্ধা সকিনা
৬৮ বছর বয়সী সকিনা বেগম এসেছেন ভারতের আসাম থেকে। তার পরিবার ও তিনি দাবি করেছেন—ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) তাকে জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে। এরপর ঢাকার একটি আদালতে তিনি আইনি ঝামেলায় আটকে গেছেন।আসামের নলবাড়ী জেলার বরকুড়া গ্রামের বাসিন্দা সকিনাকে গত ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার ভাসানটেক পুলিশ তুলে নেয়। এর আগেই তাকে নিয়ে বিবিসি বাংলায় করা একটি প্রতিবেদন সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবেদনে সকিনা এবং আসামে থাকা তার পরিবার অভিযোগ করে—বিএসএফ তাকে জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়েছে।মামলা...
৬৮ বছর বয়সী সকিনা বেগম এসেছেন ভারতের আসাম থেকে। তার পরিবার ও তিনি দাবি করেছেন—ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) তাকে জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে। এরপর ঢাকার একটি আদালতে তিনি আইনি ঝামেলায় আটকে গেছেন।
আসামের নলবাড়ী জেলার বরকুড়া গ্রামের বাসিন্দা সকিনাকে গত ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার ভাসানটেক পুলিশ তুলে নেয়। এর আগেই তাকে নিয়ে বিবিসি বাংলায় করা একটি প্রতিবেদন সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রতিবেদনে সকিনা এবং আসামে থাকা তার পরিবার অভিযোগ করে—বিএসএফ তাকে জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়েছে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ভাসানটেক থানার সাব-ইন্সপেক্টর শেখ মো. আলী সনি গত ২৫ সেপ্টেম্বর সকিনার বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়া অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য 'দ্য কন্ট্রোল অব এন্ট্রি অ্যাক্ট, ১৯৫২'-এর অধীনে তার বিরুদ্ধে মামলাটি হয়। তবে মামলায় তার নাম 'সখিনা' লেখা হয়।
কয়েক ঘণ্টা পর পুলিশ তাকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে (সিএমএম) হাজির করে। আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
এরপর থেকে সকিনা ১৬ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত তিনবার জামিনের আবেদন করেছেন, কিন্তু প্রতিবারই আদালত জামিন নাকচ করেছেন।
আজ আবারও তার জামিন শুনানি হওয়ার কথা। এজন্য সকিনাকে সকালে গাজীপুরের কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সিএমএম আদালতে আনা হয়েছে। তার আইনজীবী রহমতুল্লাহ সিদ্দিক দ্য ডেইলি স্টারকে এ তথ্য জানান।
১০ নভেম্বরের আদালতের আদেশের একটি কপি দ্য ডেইলি স্টারের হাতে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, সকিনা ভারতের নাগরিক। জামিন পেলে তিনি পালিয়ে যেতে পারেন। এতে বিচার প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে। এসব বিবেচনায় আদালত তার জামিন আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে।
'দ্য কন্ট্রোল অব এন্ট্রি অ্যাক্ট, ১৯৫২'–এর ৪ ধারায় দোষী প্রমাণিত হলে সকিনার সর্বোচ্চ এক বছর কারাদণ্ড, সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডই হতে পারে।
তার আইনজীবীরা বলেন, সকিনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা জামিনযোগ্য। বয়স, স্বাস্থ্য ও মানবিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তার জামিন পাওয়ার অধিকার রয়েছে।
নিরাপদ আশ্রয় থেকে কারাগারে যাত্রা
এ বছর জুনের প্রথম সপ্তাহে ঈদুল আজহার চার দিন আগে ভীত-সন্ত্রস্ত সকিনা ভাসানটেকের একটি দোকানের সামনে কাঁদছিলেন। দোকানটি জাকিয়া বেগম নামে এক নারীর বাড়ির কাছেই। তিনি মিরপুরের ভাসানটেকে টিনশেড এলাকার একটি বাড়িতে থাকেন।
জাকিয়ার ভাড়াটিয়া হামিদা বেগম ৪০ বছর বয়সী পোশাক কারখানার শ্রমিক, তিনি সেদিন সকিনাকে দেখেন। সেই রাতেই তিনি তাকে নিজের ঘরে আশ্রয় দেন।
পরদিন সকালে হামিদা তাকে নিয়ে যান জাকিয়ার মেয়ে ক্লান্তি আক্তারের কাছে। ২৭ বছর বয়সী ক্লান্তি এসএসসি পাস করেছেন। বিয়ের পরও তিনি বাবা-মায়ের সঙ্গেই থাকছেন।
অসুস্থ ও বিপর্যস্ত অবস্থায় থাকা সকিনাকে দেখে জাকিয়ার পরিবার স্থানীয় ফার্মেসি থেকে ওষুধ এনে চিকিৎসা দেয়। তারা তাকে সুস্থ হতে সাহায্য করে।
ক্লান্তি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা তাকে খুব অসুস্থ ও বিধ্বস্ত অবস্থায় পাই। তিনি জানান যে, দুই-তিন সপ্তাহ ধরে তিনি এই শহরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ঠিকমতো খেতেও পারেননি। খালি পায়ে হাঁটতেন বলে দুই পায়ে ক্ষত ছিল। কখনও রাস্তার কুকুর তাকে তাড়া করেছে।'
সকিনা বিস্তারিত কিছু বলতে পারেননি। শুধু দুটি শব্দ বলেছিলেন—'বরকুড়া' এবং 'নলবাড়ী'। এরপর ক্লান্তি গুগলে সার্চ করে ওই এলাকাগুলো খুঁজে পান।
দুই সপ্তাহ পর তারা জানতে পারেন, সকিনা ভারতের আসামের বাসিন্দা। ভাষাগত সমস্যা, বয়স ও স্বাস্থ্য বিবেচনায় জাকিয়া ও স্থানীয় কয়েকজন চার মাস তাকে আশ্রয় দেন। তারা চেষ্টা করেন তাকে আসামে ফিরিয়ে দিতে।
ক্লান্তি বলেন, তারা দুইবার স্থানীয় থানায় যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু কীভাবে তাকে দেশে ফেরানো যাবে, সে বিষয়ে কোনো সমাধান পাননি।
পরে তিনি সকিনার এক আত্মীয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ওই আত্মীয় 'এখন টিভি' চ্যানেলে কাজ করেন। এরপর বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদকও বিষয়টি জানতে পারেন এবং সকিনার পরিবারকে আসামে খুঁজে বের করেন।
বিবিসির প্রতিবেদন প্রকাশের পর পুলিশ সকিনাকে তাদের হেফাজতে নেয়। এখন জাকিয়ার পরিবার তার মুক্তির জন্য আইনি লড়াই চালাচ্ছে। আর্থিক কষ্টে থাকলেও তারা মামলাটি শেষ পর্যন্ত লড়বেন বলে দৃঢ়সংকল্প।
ক্লান্তি চান, সকিনা তাদের বাড়িতেই থাকুন, যতদিন না তাকে ভারতে ফিরিয়ে নেওয়া যায়।
মামলার বিবরণ
মামলার নথি অনুযায়ী, ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে সকিনাকে ভাসানটেক থানার টিনশেড টেকপাড়া গলির মাথায় পাওয়া যায়। জিজ্ঞেস করা হলে তিনি নিজেকে ভারতের নাগরিক বলে দাবি করেন।
তিনি কিছু কিছু বাংলা এবং ভারতের আসাম প্রদেশের ভাষায় কথা বলতে পেরেছেন। কিন্তু পাসপোর্ট বা ভিসা দেখাতে পারেননি। পুলিশ অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, কীভাবে তিনি বাংলাদেশে ঢুকলেন বা ঢাকায় ভাসানটেকে এলেন, এ সংক্রান্তে মামলাটি তদন্তাধীন থাকায় আসামীকে জেল হাজতে আটক রাখা প্রয়োজন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, 'সকিনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সাধারণত জামিনযোগ্য। কিন্তু আদালত জামিন দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কারণ হিসেবে দেখিয়েছে—তিনি পলাতক হতে পারেন, তার নাগরিকত্ব নিয়ে সন্দেহ আছে অথবা বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতে পারে।'
তিনি বলেন, 'তবে একজন নারী, বিশেষত বয়স্ক ও শারীরিকভাবে দুর্বল মানুষ যদি জামিনযোগ্য অপরাধে দীর্ঘদিন কারাগারে থাকেন, তাহলে এটি স্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন। সকিনা বেগমের দীর্ঘ আটকাদেশ ন্যায়বিচার, মানবিকতা এবং মানবাধিকার সুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।'