বাংলাদেশে যে গতিতে বাল্যবিয়ে কমছে, তাতে এই প্রথা পুরোপুরি বন্ধ হতে ২০০ বছরেরও বেশি সময় লাগতে পারে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)। এমন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশে আজ পালন করা হচ্ছে বিশ্ব শিশু দিবস।

দিবসটিতে এ বছরের প্রতিপাদ্য—আমার দিন, আমার অধিকার। বিশ্বের লাখো কন্যাশিশু এখনও নিরাপত্তা, শিক্ষা ও নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত—এই প্রতিপাদ্য সেই কথাই মনে করিয়ে দেয়।

কিশোরীদের মধ্যে বাল্যবিয়ে বাড়ছে। ইউএনএফপিএ জানায়, বাল্যবিয়ে কমার অগ্রগতি খুবই ধীর। বিশেষ করে ১৫-১৯ বছর বয়সী কিশোরীদের মধ্যে এই পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সদ্য প্রকাশিত মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস) ২০২৫-এর প্রাথমিক ফলাফলে কিছু তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সমীক্ষাটি ইউনিসেফের সহায়তায় গত রোববার প্রকাশিত হয়।

সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০-২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়েছে, এই হার ২০১৯ সালের ৫১ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে এ বছর কমে হয়েছে ৪৭ দশমিক ২ শতাংশ।

তবে ২০১৯ সালে ১৫-১৯ বছর বয়সী বিবাহিত মেয়েদের হার ছিল ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ, যা ২০২৫ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ দশমিক ৯ শতাংশে।

এই বৈপরীত্য দেখায়, আগের প্রজন্মের তুলনায় বাল্যবিয়ে কমেছে ঠিকই, কিন্তু বর্তমান কিশোরী মেয়েদের মধ্যে বাল্যবিয়ে আবারও দ্রুত বাড়ছে। এর মানে সমাজে এখনও ক্ষতিকর সামাজিক মানসিকতা ও পুরোনো ধ্যানধারণা পোক্ত হয়ে রয়ে গেছে। এটা মেয়েদের স্বাস্থ্য, অধিকার ও ভবিষ্যৎকে ঝুঁকির মুখে ফেলে।

গতকাল দেওয়া এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ইউএনএফপিএ জানিয়েছে, এই এমআইসিএস জরিপকে তারা স্বাগত জানায়। নারী ও মেয়েদের সুরক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন আছে। জরিপের ১৭২টি সূচকে মিশ্র চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে ২৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সাথে যুক্ত।

জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশ শিশু মৃত্যুহার কমেছে। মাতৃস্বাস্থ্য সেবায় উন্নতিও হয়েছে। হাসপাতালে প্রসব ও দক্ষ সহায়তা পাওয়া বেড়েছে। কিন্তু এসব উন্নতির পরও ইউএনএফপিএ শঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, বাল্যবিয়ে একটি গভীর সংকটে পরিণত হচ্ছে।

তাদের হিসাবে, বাল্যবিয়ে কমার গতি বছরে মাত্র ২ দশমিক ১ শতাংশ। এই হারে চললে এই প্রথা পুরোপুরি নির্মূল হতে ২০০ বছরেরও বেশি সময় লাগবে। এটি যে কেনো দেশের উন্নয়ন লক্ষ্যের সঙ্গে মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

কিশোরী মাতৃত্বের হারও (এডোলেসেন্ট বার্থ রেট-এবিআর) ৮৩ থেকে বেড়ে হয়েছে ৯২। এর মানে, আগে বিয়ে, আগে গর্ভধারণ এবং স্বাস্থ্য ও সামাজিক সমস্যার ঝুঁকি আরও বাড়ছে। এবিআর দেখাচ্ছে, প্রতি বছর প্রতি এক হাজার জন ১৫-১৯ বছর বয়সী মেয়ের মধ্যে কতজন কিশোরী মা হচ্ছে।

এমআইসিএস জরিপ বলছে, পরিবার পরিকল্পনা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ সেবার ঘাটতি কিশোরীদের অল্প বয়সে গর্ভধারণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এতে তারা আরও গভীরভাবে বাল্যবিয়ের চক্রে আটকে যাচ্ছে।

ইউএনএফপিএ বলছে, এসব বাধা ও ক্ষতিকর সামাজিক মানসিকতা না ভাঙলে বাল্যবিয়ে বন্ধের উদ্যোগ সফল হবে না।

ইউএনএফপিএর প্রতিনিধি ক্যাথরিন ব্রিন কামকং বলেন, 'বাংলাদেশ ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে হতে এবং এসডিজি অর্জন করতে চাইছে। কিন্তু মেয়েদের স্বাস্থ্য, অধিকার ও শিক্ষায় বিনিয়োগ ছাড়া এসব লক্ষ্য পূরণ সম্ভব নয়।'

ইউনিসেফের বাংলাদেশ প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাল্যবিয়ে শুধু ক্ষতিকর প্রথাই নয়, এটি শিশু ও নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা। এটি মেয়েদের শিক্ষা ও মর্যাদা কেড়ে নেয় এবং জাতীয় উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। বিয়ের বয়স কমানো নয়, আইন প্রয়োগ এবং মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি।'

মা ও শিশু স্বাস্থ্য হাসপাতালের জুনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. মনজুর-এ-মাওলা বলেন, 'অল্প বয়সে বিয়ে জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর সমস্যা। কিশোরী মেয়েদের শরীর গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত থাকে না। এতে রক্তশূন্যতা, প্রি-এক্লাম্পসিয়া, আগে প্রসব, কম ওজনের শিশুর জন্মের মতো ঝুঁকি বাড়ে। অপরিণত পেলভিক হাড়ের কারণে প্রসব জটিলতা হয়, যা মা ও শিশুর মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায়।'

তিনি আরও বলেন, 'এতে মানসিক স্বাস্থ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হঠাৎ দায়িত্ব, দাম্পত্য চাপ, স্বাধীনতা হারানো—এসব কারণে উদ্বেগ, বিষণ্নতা বাড়ে। পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়, আত্মবিশ্বাস কমে যায়, সহিংসতা ও একাকীত্বের ঝুঁকি বাড়ে।'

জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে অল্প বয়সে বিয়ে দারিদ্র্য বাড়ায়, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু বাড়ায়, জাতীয় উন্নয়ন ধীর করে। তাই মেয়েদের অধিকার রক্ষায় শিক্ষা, সচেতনতা ও আইন প্রয়োগ জরুরি বলে মনে করেন এই চিকিৎসক।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, 'বৈজ্ঞানিকভাবে ১৮ বছরের আগে মেয়েদের গর্ভধারণের শারীরিক সক্ষমতা নেই। বিয়ের পরও অনেক মেয়ে পরিবারের মধ্যে নিজের মত প্রকাশ করতে পারে না।'

তিনি আরও বলেন, 'গ্রামের পরিবারগুলোতে মেয়েদের শিক্ষার গুরুত্ব কম। কোনোভাবেই বাল্যবিয়ে গ্রহণযোগ্য নয়। অল্প বয়সে বিয়ে হলে মেয়েরা সমাজে অর্থবহ অবদান রাখতে পারে না। তাদের শিক্ষা, নিরাপত্তা ও ক্ষমতায়নের সুযোগ তৈরি করতে হবে।'

নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ বলেন, 'যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় আমরা ১২ হাজার বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছি। অন্য মন্ত্রণালয়গুলোর সহযোগিতাও জরুরি। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে বহুমুখী উদ্যোগ প্রয়োজন।'

তিনি বলেন, 'ধর্ম মন্ত্রণালয় এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আইন অনুযায়ী, ১৬ বছরের নিচে বিয়ে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, সম্মতি থাকলেও। আইন এ ব্যাপারে কঠোর। অনেকে ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়ে বাল্যবিয়েকে সঠিক বলে দাবি করেন, কিন্তু আমরা জাতীয় আইন মানতে বাধ্য।'