সরকারের হাতে থাকা নিম্ন আদালতের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণরূপে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে যাওয়ার প্রক্রিয়া আরেক ধাপ এগিয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে 'সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫' এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে গঠিত বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশেও পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ ছিল।

সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা হলে নিম্ন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি, পদায়ন ও শৃঙ্খলাবিষয়ক সব ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের হাতে থাকবে। যে ক্ষমতা বর্তমানে সরকারের হাতে আছে। তবে অবকাঠামোগত দিক থেকে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় পূর্ণাঙ্গভাবে প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর অধ্যাদেশটি কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বাজেট ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত বিষয় অধ্যাদেশের গেজেট নোটিফিকেশনের সঙ্গে এটি কার্যকর হবে।

আজ বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

আসিফ নজরুল বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীন সচিবালয়ের জন্য গত ২০-৩০ বছর ধরে নাগরিক সমাজের একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল। রাজনৈতিকভাবে অনেকে আশ্বাস দিয়েছেন, অনেক কিছু বলেছেন, এখন আমরা (অন্তর্বর্তী সরকার) একটি ভালো জায়গায় আসতে পেরেছি।

'বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠার যে শেষ ধাপ, আইনগতভাবে সেটা সম্পন্ন করলাম', বলেন তিনি।

আইন উপদেষ্টা বলেন, শুধু বিচার কাজে নিয়োজিত যারা আছেন, সেই বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা এবং ছুটির বিষয়াদি সুপ্রিম কোর্টের সচিবালয় হাতে চলে যাবে। তবে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন—আইন মন্ত্রণালয়, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনে প্রশাসনিক কাজে দায়িত্ব পালন করা বিচার বিভাগীয় অফিসারদের নিয়ন্ত্রণ সরকারের কাছেই থাকবে।

তিনি আরও বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের ইচ্ছায় নিম্ন আদালতের বিচারকদের জামিন দেওয়া বা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হতো। এই অধ্যাদেশ পরিপূর্ণভাবে কার্যকর হলে নিম্ন আদালতের বিচারকদের ওপর আইন মন্ত্রণালয় তথা সরকারের আর কোনো কন্ট্রোল থাকবে না।

আসিফ নজরুল আরও বলেন, কিন্তু এটা এই মুহূর্তে কার্যকর হচ্ছে না। কারণ সচিবালয়টা প্রতিষ্ঠা করে কার্যকর করতে হবে। সচিবালয় সম্পূর্ণভাবে কার্যকরী হওয়ার পর সরকার সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে অধস্তন আদালতের বিচারকদের ওপর তত্ত্বাবধান এবং অধস্তন আদালতের ওপর তত্ত্বাবধান নিয়ন্ত্রণ এবং শৃঙ্খলার বিষয় উচ্চ আদালতের হাতে ন্যস্ত করা হবে আশা করছি।

অধ্যাদেশটি কার্যকর হতে কতদিন লাগতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কয়েক মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ কার্যকর হয়ে যাবে।

উপদেষ্টা বলেন, এই অধ্যাদেশ কার্যকর হলে বিচার বিভাগের আর্থিক স্বাধীনতাও নিশ্চিত হবে। বিচার বিভাগের জন্য ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত প্রকল্প প্রণয়নে প্রধান বিচারপতি অনুমোদন দিতে পারবেন। এর বেশি হলে পরিকল্পনা কমিশনের মাধ্যমে একনেকে পাঠাতে হবে। একইসঙ্গে বিচার বিভাগের সব ব্যয় সংযুক্ত তহবিলের ওপর দায়যুক্ত ব্যয় হবে। এছাড়া বিচার বিভাগের জন্য বরাদ্দ করা টাকার পুনঃউপযোজন ক্ষেত্রেও সরকারের কোনো পূর্বানুমোদনের প্রয়োজন হবে না।

এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে নিম্ন আদালতের বিচারকদের আইন মন্ত্রণালয় তথা নির্বাহী বিভাগের কাজ করার সুযোগ রাখা বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ নীতির পরিপন্থী কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, প্রশাসনিক ধরনের হলেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিচারিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন অফিসারের প্রয়োজন হয়, এছাড়া প্রশাসনিক কাজে যুক্ত অফিসাররা বিচারিক কাজে যুক্ত থাকেন না।

এদিকে, আজ বৈঠকে 'মানব পাচার ও অভিবাসী চোরাচালান প্রতিরোধ এবং দমন অধ্যাদেশ, ২০২৫'-এর খসড়ার নীতিগত  অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। 'টেলিযোগাযোগ সংশোধন অধ্যাদেশ-২০২৫' এবং 'আমদানি নীতি, ২০২৫' নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হলেও অনুমোদন পায়নি। এই দুটির খসড়া আরও পর্যালোচনার জন্য মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

অন্যদিকে 'ভূমি ব্যবহার ও কৃষিভূমি সুরক্ষা অধ্যাদেশ,২০২৫'-এর খসড়া নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে। এ অধ্যাদেশটির বিষয়ে শফিকুল আলম বলেন, গত ৫৪ বছরে দেশের জনসংখ্যা আড়াই গুণ বাড়ার পাশাপাশি কৃষিজমিও দ্রুত কমছে। তাই কৃষিজমি রক্ষা করে শস্য উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে অধ্যাদেশটি প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার।

খসড়া অধ্যাদেশে দুই, তিন, চার ফসলি শস্য উৎপন্ন হয় এমন কৃষিজমিকে অকৃষি কাজে ব্যবহার করতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে জলাধার, জলাভূমি, পাহাড়, টিলা, বনভূমি, সাগর ও উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল এলাকার ভূমি সুরক্ষার ওপর ।  এছাড়া অনুমোদন ছাড়া কৃষিজমিকে অকৃষি কাজে পরিবর্তন করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের কারণে ইউএইতে জেল খেটে ক্ষতিগ্রস্ত প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এই বিষয়েও আরও পরামর্শ হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।