নির্যাতনের শিকার নারীরা কোথায় যাবেন?
মাত্র ১২ বছরেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলেন গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার শারমিন আক্তার (ছদ্মনাম)। এখন তার বয়স ৪০ বছর। প্রতিদিনের জীবনে সহিংসতা, নির্যাতন, গালমন্দ যেন তার 'তিনবেলা খাবারের মতো' নিত্যসঙ্গী।দ্য ডেইলি স্টারকে শারমিন বলেন, 'কোন কারণে তিনি আমাকে মারেননি—ভাত নরম হলে চড় মারতেন, শক্ত হলে ঘুষি, মায়ের বাড়ি গেলে মারধর। কখনো কখনো সবার সামনেই মারতেন। দুইবার তো আমার হাত ভেঙে দিয়েছেন। আমার সারা শরীরে মারধরের দাগ…।'আরও বলেন, 'কোথায় যাব, কার কাছে সাহায্য পাব, কী করব—জানতাম না। বাচ্চাগুলোও খুব ছোট ছিল। তার...
মাত্র ১২ বছরেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলেন গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার শারমিন আক্তার (ছদ্মনাম)। এখন তার বয়স ৪০ বছর। প্রতিদিনের জীবনে সহিংসতা, নির্যাতন, গালমন্দ যেন তার 'তিনবেলা খাবারের মতো' নিত্যসঙ্গী।
দ্য ডেইলি স্টারকে শারমিন বলেন, 'কোন কারণে তিনি আমাকে মারেননি—ভাত নরম হলে চড় মারতেন, শক্ত হলে ঘুষি, মায়ের বাড়ি গেলে মারধর। কখনো কখনো সবার সামনেই মারতেন। দুইবার তো আমার হাত ভেঙে দিয়েছেন। আমার সারা শরীরে মারধরের দাগ…।'
আরও বলেন, 'কোথায় যাব, কার কাছে সাহায্য পাব, কী করব—জানতাম না। বাচ্চাগুলোও খুব ছোট ছিল। তার ওপর আমি পড়াশোনা জানি না, পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই, যাওয়ার জায়গাও নেই।'
মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পর তিনি সংসার ছাড়ার সাহস জোগাতে পারেন।
'তারপরও আমার স্বামী মানসিকভাবে নির্যাতন করে গেছেন', বলেন শারমিন।
এখানেই শেষ নয়, সংসার ছেড়ে আসার পরও শারমিনকে তার প্রাক্তন স্বামী হুমকি দিয়েছেন, অপবাদ ছড়িয়েছেন, এমনকি খুঁজে বের করে মারতেও এসেছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) পরিচালিত নারীর প্রতি সহিংসতা (ভিএডব্লিউ) সমীক্ষা ২০২৪ অনুসারে, বাংলাদেশে প্রতি চার নারীর তিনজন, অর্থাৎ ৭৬ শতাংশ এমন সহিংসতার শিকার হন। তবু নারীদের ৫১ দশমিক ৫ শতাংশই জানেন না যে কোথায় অভিযোগ জানাতে হবে।
সচেতনতার হার শহর অঞ্চলে খানিকটা বেশি—৫০ দশমিক ৭ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে এই হার শতকরা ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ।
সমীক্ষায় আরও উঠে এসেছে, যেসব নারী জানেন কোথায় অভিযোগ করতে হয়, তাদের ৯১ শতাংশই নিকটবর্তী থানার কথা উল্লেখ করেছেন।
অনেক কম সংখ্যক নারীই অন্যান্য দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ সম্পর্কে জানেন। ৩২ শতাংশ নারী ইউনিয়ন বা উপজেলা পরিষদের নাম বলেছেন। গ্রাম সালিশ কেন্দ্রের কথা বলেছেন ১৩ শতাংশ, আর আদালতে যাওয়ার কথা বলেছেন মাত্র ১০ শতাংশ নারী।
গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে চালু থাকলেও ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) সম্পর্কে মাত্র ২ শতাংশ নারী অবগত।
জরুরি সেবা বা হেল্পলাইনের বিষয়ে জ্ঞানও সীমিত। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ১০৯ হেল্পলাইন সম্পর্কে জানেন মাত্র ১২ শতাংশ নারী। সেই তুলনায় অনেক বেশি জানেন জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ সম্পর্কে—৪৫ শতাংশ।
গ্রামের তুলনায় শহরের নারীরা তুলনামূলকভাবে বেশি এগিয়ে।
অঞ্চলভেদে, ময়মনসিংহে সর্বোচ্চ ১৭ শতাংশ ১০৯ হেল্পলাইন সম্পর্কে সচেতন। সবচেয়ে কম জানেন সিলেটে—১০ শতাংশ।
ঢাকায় ১০৯ সম্পর্কে সচেতনতা খুবই কম, মাত্র ৯ শতাংশ। অবশ্য ৯৯৯ সম্পর্কে জানেন ৪৯ শতাংশ নারী।
সহিংসতার শিকার নারীদের এই হেল্পলাইন দুটি নিয়ে সচেতনতা আরও কম। ১০৯ সম্পর্কে মাত্র ৯ শতাংশ আর ৯৯৯ সম্পর্কে জানেন ৩৯ শতাংশ নারী।
অবিবাহিত নারীদের এ বিষয়ে সচেতনতা সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে তালাকপ্রাপ্ত, পৃথক থাকা বা বিধবা নারীরা সবচেয়ে কম জানেন।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ড. ফাওজিয়া মোসলেম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হেল্পলাইন, পুলিশ হেল্পডেস্ক, ওসিসি—সবই গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু নারীদের সেখানে পৌঁছানোর রাস্তা আমরা তৈরি করতে পারিনি। আশঙ্কার বিষয় হলো, নারীদের সচেতনতা না বাড়লে সব চেষ্টা ও অর্থ বিফলে যাবে। সচেতনতা বাড়ানো এখন অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।'
তিনি বলেন, 'দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়াই সেবা কার্যক্রমগুলো চলে আসছে। বাজেট, জেন্ডার-রেসপন্সিভ পরিকল্পনা, সমন্বিত উদ্যোগ—এসব ছাড়া পরিবর্তন আসবে না। আমাদের প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা ও সুষ্ঠু জবাবদিহিতা। বিক্ষিপ্তভাবে কাজ করে গেলে কোনো পরিবর্তনই আসবে না।'
তিনি সতর্ক করেন, প্রশিক্ষণহীন স্থানীয় মধ্যস্থতাকারীদের ওপর নির্ভরতা নারীদের আরও বেশি নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলে। আগে অনেকবার এমন দেখা গেছে যে, ধর্ষণের পর নারীকে ধর্ষককে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়েছে।
তাৎক্ষণিক সহায়তা প্রয়োজন এমন নারীদের পথনির্দেশ দিতে দ্য ডেইলি স্টার পুলিশ, জরুরি হেল্পলাইন, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা নিয়ে কাজ করে এমন এনজিওগুলোর সঙ্গে আলাপ করেছে।
জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯–এর পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার বলেন, জাতীয় জরুরি সেবা গাইডলাইনস–২০২০ অনুসারে, নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে যেকোনো সহিংসতা, হয়রানি বা অনুসরণকে (স্টকিং) জরুরি পরিস্থিতি হিসেবে বিবেচিত হবে।
'নারী, শিশু বা তাদের হয়ে যে কেউ ৯৯৯-এ ফোন করতে পারেন,' বলেন তিনি।
চলতি বছরের শুরু থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৯৯৯ নম্বরে কল করা ২৬ হাজার ৩১৭ জনকে জরুরি সহায়তা দেওয়া হয়েছে, যেগুলো 'নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা' ক্যাটাগরির আওতায় পড়ে।
এর মধ্যে ১৪ হাজার ৯২৮টি ছিল পারিবারিক নির্যাতন, ৫ হাজার ৮১০টি অন্যের আক্রমণ, ৯৮৮টি ধর্ষণ, ৫৫৭টি ধর্ষণ চেষ্টা, ৭৯৩টি অনুসরণ, ৬৪৭টি হত্যাকাণ্ড, ৮০১টি যৌন হয়রানি, ৪৬৫টি বাবা-মায়ের নির্যাতন এবং ২ হাজার ৭৯৮টি বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত ফোন কল।
আনোয়ার জানান, সেবাগুলো এখনো বিচ্ছিন্নভাবে পরিচালিত হচ্ছে। একটি একীভূত, সর্বজন পরিচিত জরুরি নম্বরের প্রয়োজনীয়তার ওপর তিনি গুরুত্ব দেন।
পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) এএইচএম শাহাদত হোসেন জানান, সহিংসতা বা যৌন নির্যাতনের মুখোমুখি নারীদের সার্বক্ষণিক সহায়তা নিশ্চিত করতে গত ১০ মার্চ পুলিশ সদর দপ্তর ২৪ ঘণ্টার হটলাইন চালু করেছে।
ডিজিটাল থ্রেট মোকাবিলায় পুলিশের সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন আইনি সহায়তা ও সুরক্ষা প্রদান করে, জানান তিনি।
এদিকে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিস্তৃত পরিসরের সেবা দিচ্ছে।
মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ড. প্রকাশ কান্তি চৌধুরী বলেন, সদ্য চালু হওয়া কুইক রেসপন্স টিম তাৎক্ষণিক উদ্ধার, চিকিৎসা, মনোসামাজিক কাউন্সেলিং, আইনি সহায়তা, সাইবার সহিংসতার প্রতিকার, আশ্রয়, নিরাপদ স্থান ও নিরাপত্তা সেবা প্রদান করছে।
২৪ ঘণ্টার টোল-ফ্রি হেল্পলাইন নম্বর ১০৯ থেকে উদ্ধার, আইনি ও মনোসামাজিক সহায়তা, স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত দিক-নির্দেশনা, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ এবং সাইবার সহিংসতা বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
এর মধ্যে ১৪টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওসিসি, জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৬৭টি ওসিসি সেল, ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরি, আটটি বিভাগীয় ডিএনএ স্ক্রিনিং ল্যাবরেটরি, ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার, আটটি আঞ্চলিক ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টারকে অন্তর্ভুক্ত করে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টার-১০৯ সেবা দিচ্ছে।
প্রকাশ আরও জানান, ওসিসির পরিসর ৩৭টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ৯৫টি জেলা ও উপজেলায় সেল বাড়ানো হবে; পাশাপাশি ১০৯ হেল্পলাইনকে আরও দক্ষ জনবল ও নিবেদিত কাউন্সেলর দিয়ে শক্তিশালী করা হচ্ছে, যাতে একটি কলও ড্রপ না হয়।
স্কুল, কলেজ ও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিরোধকে মন্ত্রণালয় অগ্রাধিকার দিচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, মাদ্রাসায় পৌঁছাতে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ চলছে। 'সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে কমিউনিটি জনসম্পৃক্ততা, কনটেন্ট তৈরি ও পকেট লিগ্যাল গাইড কার্যক্রমকে সহায়তা করবে।'
সারা দেশে লিগ্যাল এইডের ৬৪টি জেলা কার্যালয় শারীরিক, মানসিক, যৌন বা পারিবারিক সহিংসতার মুখোমুখি নারী ও শিশুদের সহায়তা প্রদান করছে।
অনেক বেঁচে ফেরা নারী নিশ্চিত করে জানেন না কোথায় তারা সহায়তা চাইবেন। এ ক্ষেত্রে প্রথম সারির আইনি সহায়তা প্রদানকারী সংগঠনগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—কারণ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী বা আইনি জটিলতার কারণে নারীরা অনেক সময় থানায় কিংবা আদালতে যেতে চান না।
বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট নিঘাত সীমা বলেন, 'এসব সংগঠন বেঁচে ফেরা নারীদের আইনি প্রক্রিয়া বুঝতে সাহায্য করে, আদালতে তাদের পক্ষ হয়ে দাঁড়ায় এবং তাদের বক্তব্য নিরাপদে তুলে ধরার ব্যবস্থা করে।'
'তারা কাউন্সেলিং, আশ্রয় ও পুনঃএকীভূত হওয়ার সহায়তাও প্রদান করে, বিশেষ করে গ্রামীণ ও ঝুঁকিপূর্ণ নারীদের জন্য, যারা কোথায় সহায়তা চাইবেন তা জানেন না।'
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) পরিচালক মাহবুবা আক্তার বলেন, ব্লাস্ট ২৪টি জেলা অফিস ও ক্লিনিকের মাধ্যমে নিম্ন আদালত থেকে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত আইনি সহায়তা প্রদান করে, সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করে, আইনি পরামর্শ দেয়, বিরোধ মীমাংসা করে এবং জনস্বার্থ মামলা পরিচালনা করে।
পাশাপাশি সাইবারক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন ও নারীপক্ষের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত 'সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন' প্ল্যাটফর্ম অনলাইনে নির্যাতনের ঘটনা জানানো ও আইনি, কাউন্সেলিং এবং কাঠামোগত সেবা গ্রহণের সুযোগ তৈরি করে।
আসক (আইন ও সালিশ কেন্দ্র), আইসিডিডিআরবি (আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ), অ্যাকশনএইড, ডব্লিউডিডিএফ (উইমেন উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিজ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন), নারীপক্ষ, ব্লাস্টসহ ১৭টি সংগঠন ধর্ষণ আইন সংস্কারের পক্ষে কাজ করে এবং বেঁচে ফেরা নারীদের আইনি ও মনোসামাজিক সহায়তা দেয়।
সীমা বলেন, 'নারীরা যখন জানেন না কোথায় যাবেন, তখন নির্যাতন স্বাভাবিক বিষয়ের মতো হয়ে যায়। আর সেই নীরবতা ভাঙতে রাষ্ট্র, পুলিশ ও গণমাধ্যমের শক্তিশালী সচেতনতা প্রয়োজন।'