রংপুরে হারিয়ে যাচ্ছে ‘শান্তির নিবাস’ মাটির ঘর
রংপুরের বদরগঞ্জ, মিঠাপুকুর, পীরগঞ্জ ও তারাগঞ্জ উপজেলায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ ঐতিহ্যের প্রতীক—মাটির ঘর। এক সময় চার উপজেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামেই দেখা যেত এ ধরনের ঘর। এ ঘরে গরমে ঠান্ডা অনুভূত হতো, আর শীতে পাওয়া যেত উষ্ণতার পরশ। আর তাই মাটির ঘরকে বলা হতো 'গরিবের এসি'। গ্রামের লোকেরা পুকুর, গাছপালা আর সবুজে ঘেরা গ্রামীণ পরিবেশের মাটির ঘরকে শান্তির নিবাসও বলেন। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় রুচিবোধের পরিবর্তনে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়ে এখন সেই মাটির ঘর এখন বিলুপ্তির পথে।উপজেলাগুলোর বিভিন্ন ইউনিয়নে ঘ...
রংপুরের বদরগঞ্জ, মিঠাপুকুর, পীরগঞ্জ ও তারাগঞ্জ উপজেলায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ ঐতিহ্যের প্রতীক—মাটির ঘর। এক সময় চার উপজেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামেই দেখা যেত এ ধরনের ঘর। এ ঘরে গরমে ঠান্ডা অনুভূত হতো, আর শীতে পাওয়া যেত উষ্ণতার পরশ। আর তাই মাটির ঘরকে বলা হতো 'গরিবের এসি'।
গ্রামের লোকেরা পুকুর, গাছপালা আর সবুজে ঘেরা গ্রামীণ পরিবেশের মাটির ঘরকে শান্তির নিবাসও বলেন। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় রুচিবোধের পরিবর্তনে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়ে এখন সেই মাটির ঘর এখন বিলুপ্তির পথে।
উপজেলাগুলোর বিভিন্ন ইউনিয়নে ঘুরলে এখন হাতে গোনা কয়েকটি মাটির ঘর চোখে পড়ে। এসব মাটির ঘর আজও দাঁড়িয়ে আছে অতীত ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে। শৈল্পিক কারুকাজে ভরা মাটির ঘর যেন বলে যায় তার হারিয়ে যাওয়া সময়ের গল্প।
স্থানীয়রা জানান, প্রায় এক যুগ আগে মাটির ঘর নির্মাণ সংস্কৃতি বন্ধ হয়ে যায়। আগে যেসব ঘর নির্মাণ করা হয়েছিল, সেগুলোর কিছু এখন টিকে আছে। কিছু ঘরের চাল খড়ের আবার কিছু টিনের। একসময় যেই বাড়িতে বড় মাটির ঘর ছিল সেই পরিবারকে ধনী পরিবার হিসেবে ধরা হতো। অধিকাংশ বাড়ির মাটির ঘর এখন ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে টিনের অথবা ইটের ঘর।
বদরগঞ্জ মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ বিমলেন্দু সরকার বলেন, 'ছোটবেলায় আমরা মাটির ঘরেই থাকতাম। গরমে ফ্যানের প্রয়োজন হতো না। এমন আরামদায়ক ঘর এখন আর পাওয়া যায় না। মাটির ঘর আমাদের কাছে শান্তির নিবাস। আমরা শান্তিকে হারিয়েছি আধুনিক রুচির কাছে। এখনো যারা মাটির ঘরে বসবাস করছেন, তারা ইতিহাস আর স্মৃতিকে লালন করছেন।'
বদরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, 'আগে আমাদের এলাকায় অসংখ্য মাটির ঘর ছিল। কিন্তু মানুষের রুচিবোধের পরিবর্তনে এখন আর কেউ তেমন ঘর বানায় না। আমি মনে করি, মাটির ঘরের ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা উচিত— এটি আমাদের শেকড়।'
মিঠাপুকুর উপজেলার মিলনপুর গ্রামের রাজমিস্ত্রি যোগেশ চন্দ্র সরকার (৬৫) বলেন, আগে খুব সহজে মাটির ঘর তৈরি করা যেত। এঁটেল দো–আঁশ মাটি, একটু পানি আর শ্রম— এই ছিল মূল উপকরণ। কৃষক পরিবারের সদস্যরা মিলেই একটি ঘর তৈরি করে ফেলতেন।
'মাটি পানি দিয়ে কাদায় পরিণত করে এক দেড় ফুট করে দেয়াল তোলা হতো। পুরো ঘর তৈরি করতে সময় লাগত তিন–চার মাস। এসব ঘর গরমে ঠান্ডা, শীতে উষ্ণ থাকত। ঝড়-বন্যা না হলে শত বছর পর্যন্ত টিকে থাকত,' বলেন যোগেশ।
তিনি বলেন, গ্রামীণ নারীরাও ঘরের সৌন্দর্য বাড়াতে প্রতিদিন সকালে কাদা দিয়ে দেয়াল লেপে শান দিতেন। তাদের হাতের কোমল স্পর্শে মাটির ঘরগুলো পেত নতুন প্রাণ।
বোয়ালিয়াপাড়া গ্রামের ৬৫ বছর বয়সি মেহের জামাল বলেন, 'এখন আর মাটির ঘর চোখে পড়ে না বললেই চলে। তবে বাপ–দাদার স্মৃতি ধরে রাখতে দুই-একটা ঘর এখনো টিকিয়ে রেখেছি। মানুষ এখন টেকসই পাকা ঘরকেই বেশি নিরাপদ মনে করে। আমার বাবার রেখে যাওয়া মাটির ঘরে আমি এখনো বসবাস করছি। এ ঘরে বসবাস খুবই আরামদায়ক। এটি আমার কাছে শান্তির নিবাস।'
কালুপাড়া গ্রামের বাসিন্দা কাশিনাথ দাস (৫৬) জানান, তিনি পৈতৃক সূত্রে মাটির ঘর পেয়েছেন। কিন্তু নতুন করে কেউ আর এমন ঘর তৈরি করে না। 'মাটির ঘরে আরামের ঘুম হয়,' তিনি বলেন।
বিষ্ণুপুর গ্রামের মুদির দোকানদার খলিলুর রহমান (৪৫) বলেন, 'মানুষ এখন নিরাপত্তা ও টেকসই কাঠামোর কথা ভেবে ইট–সিমেন্টের বাড়ি নির্মাণ করছে। সময়ের প্রয়োজনে ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের বাড়িতে দুটি মাটির ঘর ছিল। এগুলো ভেঙে ফেলেছি। নতুন করে ইটের বাড়ি নির্মাণ করেছি।'
পীরগঞ্জের অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক নিহারঞ্জন চক্রবর্তী (৮০) বলেন, 'আজ মাটির ঘর হয়ে উঠেছে কেবল স্মৃতি, গল্প ও সাহিত্যের উপাদান। সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে সেই মাটির ঘর, যার ছায়ায় একদিন বড় হয়েছি আমরা সবাই। হয়তো খুব দূরে নয় সেই দিন, যেদিন মাটির ঘর থাকবে শুধু বইয়ের পাতায়, কবিতার ছন্দে কিংবা জাদুঘরের প্রদর্শনীতে।'